ডক্টর নাইয়ুম চৌধুরীকে আমি প্রথম দেখি ডেইলি স্টারের একটি গোলটেবিলে ২০০৯ সালের দিকে। এর আগেও স্যারের নাম শুনেছি। সামনাসামনি দেখিনি। বাংলাদেশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেজ নামক সংস্থাটিতে তিনি দীর্ঘকাল জড়িত ছিলেন। যে-পদেই থাকুন তিনি সংস্থাটির একজন নেতৃস্থানীয় কর্তাব্যক্তি ছিলেন। বইমেলায় আমি স্যারকে দেখেছি ঘুরে ঘুরে একাডেমির অনুষ্ঠানের জন্য বই নির্বাচন করতে। এই একাডেমি বাংলাদেশের বিজ্ঞান এস্টাবলিশমেন্টের একটা বড় প্রতীক। এছাড়া অবশ্য স্যার ছিলেন একজন সফল জৈবপ্রযুক্তিবিদ। এবং সবচেয়ে বড় কথা, তিনি ছিলেন আণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান। এই পদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ। খুব বড় বিজ্ঞানী না হলে এই পদে ওঠা যায় না। একইসাথে বিজ্ঞানের কর্মকাণ্ড এবং প্রশাসনের কাজ, তারপর আবার সরকারী আমলাদের সাথে ওঠবস করতে হয়, সরকার-যন্ত্রকে ভালভাবে জানতে হয়, বুঝতে হয়, বৃহৎ বৈজ্ঞানিক মহাপ্রকল্পের ব্যবস্থাপনা জানতে হয়। বলা যেতে পারে, ড. ওয়াজেদ মিয়াদের যে প্রজন্ম কমিশনের দায়িত্ব দক্ষতার সাথে পালন করেছেন, ড. নাইয়ুম চৌধুরী সেই প্রজন্মেরই শেষ প্রতিনিধি। এই রকম একাগ্র বিজ্ঞানী এবং দক্ষ প্রশাসক খুব বিরল। আমাদের সায়েন্স এস্টাবলিশমেন্টে যে-কজন মানুষ দক্ষতার সাথে উঁচুতে উঠেছিলেন, নাইয়ুম স্যার তাঁদের অন্যতম। বিজ্ঞানে একইসাথে ল্যাবরেটরির বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ড এবং প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট, তদুপরি আমলাতান্ত্রিক কাজেকর্মে দক্ষতা এবং সরকার-যন্ত্রের সাথে কথোপকথন, তাদের বোঝা, তাদের বোঝানো - এটা একজন দক্ষ বিজ্ঞান-প্রশাসকের কাজ। সায়েন্স ব্যুরোক্রেসি এজন্য গুরুত্বপূর্ণ। ল্যাবে কাজ করেন যে বিজ্ঞানী, তিনি এই কাজটাকে গুরুত্ব দিতে চান না, কিন্তু এটা না থাকলে সরকারী-যন্ত্র আপনাকে চিনবে না, আপনার ফান্ড আসবে না। মহা প্রকল্প বাস্তবায়িত হবেনা। বিজ্ঞানের উন্নয়নে বড় প্রকল্পের দরকার আছে, আর সেখানেই কমিশনের গুরুত্ব। এহেন বিরল দায়িত্বেই দক্ষ ছিলেন নাইয়ুম স্যার। পরে তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়েও অধ্যাপনা করেন। তখন আমার সাথে তাঁর যৎকিঞ্ছিত কথোপকথন হয়েছিল। সম্ভবত একদিন বিলাত থেকে তিনি আমায় ফোন দিয়ে বসলেন, একটি কাজের জন্য। সেটা ২০১১ সালের ডিসেম্বর। মেইলটা আমার কাছে এখনো আছে। আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম, আমার মত কিঞ্চিধদিক সহকারী অধ্যাপকের তাঁর মত বড়মাপের মানুষের কী প্রয়োজন থাকতে পারে। যাহোক, পরে নাইয়ুম স্যার বাংলাদেশ আণবিক শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (বায়রা) চেয়ারম্যান হলেন। এই দপ্তরটি তৈরি হয়েছিল রূপপুর পরমাণু প্রকল্পের যাবতীয় রেগুলেটরি এফেয়ার্স এবং ইন্টারন্যাশনাল আইনকানুন এবং লাইসেন্সিং এর কাজ তদারকি করতে। নাইয়ুম চৌধুরী ছাড়া এই কাজটির জন্য বিকল্প চেয়ারম্যান ভাবা কঠিন। ঠিন যেদিন তিনি এই কাজে নিয়োগ পেলেন, সেদিন আমরা ঢাকাস্থ আণবিক শক্তি কমিশনের অডিটরিয়ামে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি এজেন্সির একটি কর্মশালার শেষ দিন অতিবাহিত করছিলাম। আমরা এই খবর পেলাম, এবং স্যারও এলেন এবং আমরা একটা যৌথ ছবি তুললাম। এরপর বায়রা'র কিছু মিটিং এ আমি গিয়েছি, স্যারের সাথে দেখাও হয়েছে, তেমন কথা হয়নি।এছাড়া বাংলাদেশের প্রথম ন্যানোটেকনোলজি কনফারেন্সেও নাইয়ুম চৌধুরী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এমন আরো অনেক কনফারেন্স এবং কর্মকাণ্ডে স্যার জড়িত ছিলেন। গভমেন্ট মেশিনারি তিনি খুব ভাল বুঝতেন। আমাদের দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নীতিমালা, কর্মপরিকল্পনা এবং ন্যাশনাল বায়োটেকনলজি পলিসির সূত্রায়নে স্যারের অনেক ভূমিকা ছিল। ভারতে যেমন ছিলেন বিক্রম সারাভাই, হোমি ভাবা; বাংলাদেশেও তেমনি কয়েকজনের মধ্যেই ছিলেন ডক্টর নাইয়ুম চৌধুরী। দেশের সায়েন্স এস্টাবলিশমেন্টে স্যারের ভূমিকা সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করছি।স্যার আজ মারা গেলেন। বাংলাদেশ একজন দক্ষ বিজ্ঞান-প্রশাসক হারালো।