আমার বাবা ডঃ নঈম চৌধুরী বেঁচে থাকলে আজ ২৭ সেপ্টেম্বর তাঁর ৭৩তম জন্মদিন পালন করতাম। আজ তাঁর মৃত্যুর ১৯তম দিন।প্রথম উপসর্গ দেখা যাওয়ার দুই মাসেরও কম সময়ের মধ্যে বাবা ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর দুরারোগ্য ব্যাধি যে পর্যায়ে ধরা পরেছে ১৪আগষ্ট তারিখে, তাতে তার চিকিৎসা করা ছিল বর্তমান চিকিৎসা বিজ্ঞানের আয়ত্তের বাইরে।
বাবা বেঁচে থাকতে কাজ পাগল মানুষ ছিলেন। যে কাজের দায়িত্ব নিতেন, নিজের পুরোটুকু দিয়ে কাজটি করতে পছন্দ করতেন। ঢাকাপরমাণু শক্তি কেন্দে তিনি একজন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন ১৯৬৮ সনে। কর্মজীবনে তিনি ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়ে অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ২০১৫ সন পর্যন্ত এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশলবিশ্ববিদ্যালয়ে খাদ্যনিরাপত্তা বিষয়ে অধ্যাপনা করেছেন। জাতীয় জীববিজ্ঞান ইন্সটিটিউট এর প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব তিনি সফলভাবে পালন করেছেন। ২০০৩ সনে পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে চাকুরীর অবসর হবার পর থেকে বাংলাদেশ বিজ্ঞানএকাডেমীর কাজে নিজেকে সর্বতো নিয়োজিত রাখতেন, যেটা ছিল সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাসেবা। বিজ্ঞান একাডেমীর পক্ষে উকিলের বাসায় তিনিনিজে ছুটে যেতেন এবং তারই মাঝে একদিন চুরি যাওয়া ম্যানহোলের ঢাকনার কারণে পরে গিয়ে তাঁর পায়ের দুটি অস্থিতেই স্পাইরালফ্র্যাকচার হয়। বিছানায় শুয়ে শুয়ে তাঁর কাজ দেখেছি, একাডেমীর মিটিং আমাদের বাসায় এসে সবাই করেছিলো, এবং ভাঙ্গা পা নিয়েইতিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়েছিলেন তাঁর জাতীয় জীবপ্রযুক্তি নীতিমালা (National Biotechnology Policy) উপস্থাপন করতে।নীতিমালার যে খসড়া, তা তিনি নিজ হাতে তৈরি করেছিলেন, এবং কোন পারিশ্রমিক গ্রহণ করেন নি এই কাজের জন্যে। ২০০৫ এ ব্র্যাকবিশ্ববিদ্যালয়ে বাবা জয়েন করে নতুন করে নিজের ক্যারিয়ার শুরু করেন পূর্ণকালীন শিক্ষক হিসেবে- ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়েরজীবপ্রযুক্তিবিদ্যা, অণুজীববিজ্ঞান ও ফার্মেসি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করলেন। বাবা সবসময়ে শিক্ষকতাকে পছন্দ করতেন, এবং আমাকেওউৎসাহিত করতেন এই পেশায় আসতে।
আমার বাবার নিজ দেশের মঙ্গলের জন্য ও দেশের মানুষের জন্যে ছিল এক অকৃত্রিম ভালোবাসা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়, বাবা কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পি এইচ ডি করছিলেন। তিনি কুইবেক বাংলাদেশ স্বাধীনতা সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেনএবং ১৯৭১ এর ৭ই মার্চ Bangladesh Liberation Force গঠন করেন। পিএইচডি স্থগিত করে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বপক্ষেজনসচেতনতা ও পশ্চিম পাকিস্তান দখলদার সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তাঁর প্রত্যক্ষ দূরদর্শী হস্তক্ষেপে কানাডা সরকারের গোপনেপাকিস্তানকে অস্ত্রবিক্রির পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রে (ষষ্ঠ খন্ড পৃষ্ঠা ৬৫০) লেখা আছে। কিন্তুতাঁর মুক্তিযুদ্ধের কোন সার্টিফিকেট ছিলনা। তিনি দেশে ফিরে আসেন ও পরবর্তীতে ১৯৭৮ সনে অস্ট্রেলিয়াতে কলম্বো প্ল্যান বৃত্তি নিয়েনিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয় বায়োটেকনোলজিতে পিএইচডি করতে যান। অস্ট্রেলিয়াতেও তাঁর জন্যে তার সুপারভাইজরইমিগ্রেশনের প্রস্তাব আনলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে ১৯৮২ সনে দেশে ফিরে আসেন ও কমিশনে যোগদান করেন পরমাণু বিকিরণ - খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে গবেষণা করতে। তিনি ছিলেন বাংলাদেশে জীবপ্রযুক্তিবিদ্যা (Biotechnology) তে প্রথম পিএইচডি। আমি যখনপিএইচডি করতে দেশের বাইরে যাই, তিনি যদিও বলতেন আমি যেখানে চাই সেখানেই থাকতে পারবো, কিন্তু অন্তর থেকে চাইতেন, আমিযেন দেশে ফিরে আসি, এবং দেশের সেবা করি। যখনই আমার শিক্ষাছুটি নবায়নের সময় হয়েছে, তিনি নিজে ছুটে গেছেন আমারদরখাস্ত নিয়ে।
তিনি কাজ ভালবাসতেন, এবং কখনও কাজ পেন্ডিং রাখতে পছন্দ করতেন না। ডঃ ওয়াজেদ মিয়া যখন কমিশনের চেয়ারম্যান, প্রায়ইতারা রাত ৮টা বা ৯টা পর্যন্ত অফিসের প্রশাসনিক ফাইল সম্পন্ন করতেন। কখনও বাবা কে দেখি নি বাড়তি ঘণ্টা কাজ করতে কোনওআপত্তি করতে। দুর্নীতির সাথে কখনও তাকে আপোষ করতে দেখি নি। এ ব্যাপারে আমার মা ও অত্যন্ত আপোষহীন ছিলেন। সৎনিষ্ঠাবান এই মানুষটি কাজের জন্যেই কাজ করতেন, কখনও সুবিধা বা অর্থের জন্যে নয়। একবার আয়কর অফিসে বাবাকে ডেকেএকজন কর্মকর্তা ঘুষ দাবী করলে বাবা প্রচণ্ড রেগে গিয়ে সেই অফিসে সবচেয়ে বড় কর্মকর্তার কাছে গিয়ে সরাসরি বলেছেন যে অমুকআমার কাছে ঘুষ চাচ্ছে। তিনি ঐ অফিস থেকে সেদিন বের হয়ে গিয়েছিলেন। রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি রোধ বাবাকে ক্লান্ত করেছিলো, কিন্তুজীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ন্যায়ের পথে অটল ছিলেন।
পরবর্তীতে অবসর গ্রহণের ১১ বছর পরে, বাংলাদেশ সরকার তাঁর মেধাকে দেশের কাজে নিয়োজিত করতে তাঁকে বাংলাদেশ পরমাণুশক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেন। সেই নিয়োগের দ্বিতীয় মেয়াদের দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় তিনি চলেগেলেন আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে। হাসপাতালে যাওয়ার আগের দিন রাত ১২টা পর্যন্ত অফিসের যাবতীয় ফাইল সই করেছেন। নিজেরঅন্তিম শয্যায় তিনি যখন স্টেজ ৪ অগ্নাশয়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত, তখনো তিনি হাসপাতালে বসে ফাইল সাইন করেছেন যেন অফিসেরকাজ আটকে না থাকে।
তিনি মানুষের উপকার করতে পছন্দ করতেন। কেউ যদি এসে কোন ধরনের সাহায্য বা তদবিরের সুবিধা চাইতেন, বাবা নিজ সামর্থ্যঅনুযায়ী তাকে সহায়তা করতেন। আরেকটি ঘটনা বাবার কাছে শোনা, বাবার অফিসে এক ব্যক্তি হঠাৎ এসে এক Recommendation Letter চায়। বাবা তাকে জিজ্ঞেস করে তাকে আদৌ বাবা চিনে কিনা। সেই ব্যক্তি বাবার পায়ে ধরে বলেছিলেন যে “স্যার, সবাই বলেছেনযে একমাত্র আপনিই আমার এই উপকারটি করতে পারবেন।” বাবা তাকে Recommendation দেয়, এবং তার বদৌলতে সে স্কলারশিপপেয়ে যায়। জীবনে অসংখ্য মানুষের উপকার করেছেন তিনি, এবং আমাকে বলতেন যে মানুষের উপকার করে কখনও সেটা মনে রাখতেনাই। বাবা মানুষের উপকার করে এক আত্মতৃপ্তি পেতেন।
ক্যান্সারের মৃত্যুযন্ত্রণা কাছ থেকে দেখবার দুর্ভাগ্য আমার এর আগে হয় নি। বাবার উপসর্গ গুলি কিছুটা নিরুপম করবার জন্য সবচেয়েশক্তিশালী বেদনানাশক দিতে হয়েছে। মুখের শেষ আহারটুকুও যখন আর পাকস্থলী নিতে না পেরে গাড়সবুজ বমি হিসেবে শরীর নির্গমনকরলো, তখন তার দেহে পুষ্টি দিতে CV লাইন করে সব পুষ্টি দিতে হচ্ছিলো। যকৃত যখন কাজ করা বন্ধ করে দিলো, এবং দেহের দূষিতরক্তকে আর পরিশোধিত করতে পারলো না, তখন ধীরে ধীরে অসামান্য মানুষটির চেতনা লোপ পেয়ে গেলে হেপাটিক এন্সেফালোপ্যাথিরজন্য। যে বাবা ডায়াবেটিস এর জন্যে ব্যাথার বোধ কম বলে সব সময় ঠাট্টা করতেন, তিনিই ক্যান্সারের ব্যাথায় কাতরাচ্ছিলেন এবংব্যাথার জন্যে মুখে গোঙ্গানির আওয়াজ করছিলেন। মৃত্যুকামনা কখনওই করা উচিত নয় কারো, নিজ জন্মদাতা পিতামাতার তো নয়ই, কিন্তু, বাবার সেই অন্তিম সময়ের মৃত্যুযন্ত্রণার অস্থিরতায় কখনও কখনও মনে হচ্ছিলো, ওনার “হায়াত দরাজ” করবার প্রার্থনা করেহয়তো আমরা তার কষ্টটাকেই দীর্ঘায়িত করছি। বাবার শেষ নিঃশ্বাসটুকু ফেলতে দেখেছি আমাদের সামনে ও শেষ হৃদস্পন্দনটুকু ওকার্ডিয়াক মনিটরে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে এমন অসামান্য মানুষটি এতো দ্রুত শেষ হয়ে যাবে।
ক্যান্সারে আক্রান্ত মুমূর্ষু বাবাকে মনে রাখতে চাইনা। বাবা বেঁচে থাকুক আমাদের স্মৃতিতে, একজন সফল বিজ্ঞানী, বিজ্ঞান প্রশাসক, অধ্যাপক, সৎমানুষ, নিষ্ঠাবান দেশপ্রেমিক ও একজন সফল বাবা হিসেবে।
সাজিদ মুহাইমিন চৌধুরী, পিএইচডি
সহকারী অধ্যাপক, তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক্স কৌশল বিভাগ