বাংলাদেশে জীবপ্রযুক্তিঃ ড. নঈম চৌধুরীর অভাবটা প্রকট

ডঃ নঈম চৌধুরীর কথা ভাবলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে সদা হাস্যসৌম্যবুদ্ধিদীপ্ত একটি চেহারাযা যে  কাউকে প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ করে। তাঁর শুভ্র চুল তাঁর আকর্ষণ আরো বাড়িয়ে তুলতো। আর কি সুন্দর করে কথা বলতেন। এটি ছিল তাঁর আরো একটি অস্ত্র যা দিয়ে মানুষের মন অনায়াসেই জয় করে ফেলতেন। তার এ সমস্ত গুণের জন্যই বোধ করি তার অবসর জীবনে প্রবেশের ১১ বৎসর পর সরকার তাকে ডেকে Bangladesh Atomic Energy Regulatory Authority (BAERA) র চেয়ারম্যান বানিয়েছিল। এ এমন একটি পদ যেখানে রাশিয়া সহ বিভিন্ন দেশ এবং আন্তর্র্জাতিক সংস্থার সাথে প্রতিনিয়তই দেন দরবারের জন্য বাংলাদেশের হয়ে কাজ করতে হতো। এক্ষেত্রে ডঃ নঈমের চেয়ে যোগ্য ব্যক্তি আর কেউ হতে পারতো বলে আমার মনে হয় না।

ডঃ নঈমের সাথে আমার পরিচয় শুধুমাত্র তিনি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগ থেকে পাস করা একজন স্নাতক বলে নয়। তাঁর সাথে সাক্ষাতে পরিচিত হওয়ার আগেই তাঁর সম্পর্কে অনেক কিছু জানার আমার  সুযোগ হয়েছিল অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমানের কাছ থেকে।  তাঁরা সহপাঠি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণরসায়ন বিভাগে প্রথম স্নাতক ব্যাচের। আর অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান প্রাণরসায়ন বিভাগে আমার শিক্ষকই শুধু নয় উনি আমার এম এস থিসিসের তত্ত¡বধায়কও ছিলেন এবং পরবর্তীতে আমার সহকর্মী। স্যারের সাথে এই দীর্ঘ পথচলায় তাঁর বন্ধু ড. নাঈমের অনেক গল্প শুনেছি। এছাড়া ডঃ নঈম থাকতেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কমিটিতেযখনই বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়ে গিয়েছি প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য interview দিতে তখনই ড. নঈম এর নির্বাচনি বোর্ডে থাকাটা অনিবার্য ছিলো। ফেলোশিপের বা প্রজেক্ট ফান্ডিং কমিটি বা Biotechnology বিষয়ক Workshop-এ ও তাঁর  উপস্থিতি অপরিহার্য  ছিল। এই সুবাদে তাঁর সাথে আমার পরিচিতি বাড়তে থাকে।

জাতীয় জীবপ্রযুক্তি সংস্থাটি দেশের কোথায় স্থাপিত হবে তা নিয়ে যখন বিতর্ক চলছিলো এবং কোথাও এই সংস্থাটির জন্য স্থান পাওয়া যাচ্ছিল না তখন বাংলাদেশ পরমানু গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে কর্মরত ডঃ নঈম চৌধুরী সাভারে এই কেন্দ্রর সুবিশাল পরিসরে এই গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাটির স্থান সংকুলান করে বাংলাদেশে জীবপ্রযুক্তি বিষয়ক গবেষণার দ্বার  উন্মোচিত করেছিলেন। পরবর্তীতে পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রের মহাপরিচালক হিসেবে নতুন এই জীবপ্রযুক্তি সংস্থাটি যাতে একটি শক্ত ভীতের উপর দাঁড়াতে পারে তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও করেছিলেন।

দেশে জীবপ্রযুক্তি নীতিমালাও তাঁর হাত ধরেই প্রণীত। এই নীতিমালা হালনাগাদও হয়েছিল তাঁর হাত দিয়েই। দেশের ভেতর যেখানেই জীবপ্রযুক্তি সেখানেই ডঃ নাঈম চৌধুরীর সপ্রতিভ উপস্থিতি সবাই অনুভব করেছে। জীবপ্রযুক্তির সাথে সম্পর্কিত Biosafety। সেই Biosafety নীতিমালা প্রণয়নে ও তাঁর অবদান। এই নীতিমালা বাস্তবায়নে ও ছিল তার সম্পৃক্ততা । বাংলাদেশের জীবপ্রযুক্তিতে তার অবদান যুগযুগ ধরে দেশের জীবপ্রযুক্তিবিদরা মনে রাখবে।

আরেকটি অঙ্গন যেটি নঈম চৌধুরীর পদচারনায় মুখরিত থাকতো এবং যে প্রতিস্থানটির কথা বলতেই তাঁর কথা বোঝাতো তা হচ্ছে বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী। এই একাডেমীটি প্রতিষ্ঠিত হবার পরও অনেকদিন প্রায় নিস্তেজ অবস্থায় ছিলো। প্রতিস্থানটির কর্মকান্ড খুব একটা দৃশ্যমান ছিলো না। ডঃ নঈম চৌধুরী এই একাডেমীর কাউন্সিল সদস্য হবার পর থেকে প্রতিস্থানটি গতিশীল হয়। আস্তে আস্তে কলেবরে বড়ো হতে থাকে। 

US Department of Agriculture যখন তাদের বাংলাদেশের গবেষণার অর্থ সরকারের কাছ থেকে স্থানান্তরিত করে একাডেমিতে নিয়ে এলো তখন অর্থ স্থানান্তরের সাথে সম্পর্কিত সকল দেন দরবার করে একাডেমী যাতে লাভবান হয় সেটি তিনি নিশ্চিত করেছিলেন। একাডেমীর এখন একটি বড়ো কর্মকান্ড হলো USDA  এর অর্থ দিয়ে তৈরী তহবিলযাকে  BAS-USDA নাম দেয়া  হয়েছেতার মাধ্যমে দেশের কৃষি এবং খাদ্য নিরাপত্তা খাতের প্রকল্প অর্থায়ন করা।

যে বিজ্ঞান একাডেমী বেশির ভাগ বিজ্ঞানীদের কাছেও অপরিচিত ছিল সেই একাডেমি এখন সকল বিজ্ঞানী তো বটেই অনেক সাধারণ মানুষের কাছেও পরিচিতবিশেষ করে বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডের কারনে। এ বছর বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি দ্বাদশ বারের মতো বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডের আয়োজন করলো। প্রথম দশটির আয়োজনের পুরোভাগে ডঃ নাঈম উৎপ্রতভাবে জড়িত ছিলেন। এই অলিম্পিয়াড যে বিজ্ঞান একাডেমীর একটি প্রসংকশিত কর্মকান্ডে পরিনিত হয়েছে তাঁর পিছনে রয়েছে ডঃ নাঈম চৌধুরীর বিশাল অবদান। এখন যে বিজ্ঞান একাডেমী নিয়মিত তরুণ গবেষকদের সম্মেলনের আয়োজন করছে সেটির ও কৃতিত্বের দাবিদার ড. নঈম চৌধুরী। 

তাঁর সাথে একাডেমীর অনেক  কাউন্সিল সভায় অংশ গ্রহণ করার সুযোগ আমার হয়েছিল। অবাক হয়ে দেখতাম কোন কিছুতে খুব বিরক্ত হলে ও কঠিন কন্ঠে দ্বিমত পোষন করতেন ঠিকই কিন্তু তাঁর উচ্চ কন্ঠস¦র কেউ কোনদিন শোনেনি। তার পর আরো অবাক হতাম যখন তিনি সভা শেষেই যার উপর বিরক্ত হয়েছিলেন তাকেই কাছে টেনে হাসি মুখে কথায় মেতে যেতেন। আমি একবার তাঁকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তাঁর জবাব - সভার বিষয় কি সভার বাইরেও টানা উচিৎএরকম মানুষের কাছ থেকে সব সময় কিছু না কিছু  শেখার থাকে। এখন আমি এই একাডেমীরই সম্পাদক। একাডেমীর সম্পাদকের অনেক দ্বায়িত্বঅনেক কাজ। যখন ড. নাঈম এই দায়িত্ব নেবার কথা বললেন তখন দ্বায়িত্ব নিতে  ভয় থাকলেও বিচলিত হইনি। যেখানে ডঃ নাঈমের মতো একাডেমীর প্রাণপুরুষ সভাপতি থাকবেন সেখানে আমি একাডেমীর বিষয়ে একটু কম জানলেই বা ক্ষতি কি। তাই সাহস করে রাজি হয়েছিলাম।

আমি দু মাসের জন্য মেয়ের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গেলামঠিক ছিল ফিরে এসে কাউন্সিল নির্বাচনে অংশ নেয়া তারপর দায়িত্ব বুঝে পাওয়া। এর মাঝে সব উলোট পালোট হয়ে গেলো। যা দুঃস¦প্নেও ভাবিনি তাই ঘটে গেল।  আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকতেই একাডেমীর ততকালীন সভাপতিঅধ্যাপক কাজি আব্দুল ফাত্তাহর ফোন পাই। আমি অবাক। তাঁর কথা শুনে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মতো অবস্থা। ডঃ নঈম গুরুতর অসুস্থবাঁচার সম্ভাবনা কম। এও কি হতে পারেযাঁর এখনো দেশকেজাতিকে অনেক কিছু দেবার আছে তাঁকে নাকি আর বেশীদিন আমাদের মাঝে পাবো না। এর মধ্যে প্রায় প্রতিদিন দুরু দুরু চিত্তে একাডেমীর পরিচালকড. মাজেদকে ফোন করতাম এবং তার সাথে কথা বলে আরো হতাশাগ্রস্ত হতাম। এরই মধ্যে একদিন খবর এলো অধ্যাপক নাঈম চৌধুরী আর নেই। তখন মাকিন যুক্তরাষ্ট্রে বিকেল। নাতিকে নিয়ে বাইরে হাঁটতে যাবোপারলাম না। পা দুটো অসার হয়ে গেল।

এখন আমি বিজ্ঞান একাডেমীর সম্পাদকপ্রায় প্রতি কাজে তাঁকে মনে পড়ে। তার অভাবটা প্রতিনিয়ত অনুভব করি। ড. নঈম চলে গেছেন না ফেরার দেশে। দোয়া করি যেখানে আছেন সেখানে যেন অনেক ভালো থাকেন।



হাসিনা খান,
সম্পাদকবাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী

Pages