অধ্যাপক ড. নঈম চৌধুরী স্যার: কিছু স্মৃতি, কিছু অনুভুতি - ড. ইয়ারুল কবীর

কিছু কিছু ব্যক্তিত্ব আছেন যাঁদের নাম শোনার সাথে সাথে মনের ভিতর থেকে শ্রদ্ধা চলে আসেতাঁদেরই একজন শ্রদ্ধেয় নঈম চৌধুরী স্যার। নঈম চৌধুরী স্যারকে নিয়ে আমাকে কিছু লিখতে বলা হলো যদিও স্যার সম্পর্কে লেখার অনেক কিছু আছেকিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না কি লিখবলিখলেও লেখাটা কীভাবে এবং কোথা থেকে শুরু করব। স্যারের সাথে কাটানো অনেক সুখ স্মৃতি রয়েছেকোনটা ছেড়ে কোনটা লিখব। শ্রদ্ধেয় স্যারকে নিয়ে দুচার কথা লিখতে হলেও যে যোগ্যতার প্রয়োজন আমার তা যথেষ্ট আছে বলে মনে করি না। তাছাড়া কি লিখতে গিয়ে কি লিখি এই আশঙ্কা মনের ভেতর বার বার ঘুরপাক খাচ্ছে। স্যারের চমৎকার ব্যক্তিত্ব এবং গুণের কোন দিকটা রেখে কোন দিকটা নিয়ে লিখিব তাও ঠিক করতে পারছি না। সল্প পরিসরে তাঁর সম্বন্ধে সব কিছু ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। আজ স্যার আমাদের মাঝে নেইকিন্তু স্মৃতি গুলো জল জল করে ভাসছে আমার চোখে।

নঈম চৌধুরী স্যার ছিলেন বহুগুণের অধিকারী একজন কর্মচঞ্চলকিংবদন্তি মানুষ। স্যারের সংস্পর্শে যারা এসেছেন তারা নিশ্চয়ই এ বিষয়টি লক্ষ্য করেছেন যেতিনি ছিলেন এমন একজন পরিপূর্ণ আলোকিত মানুষ যাঁরা এ সমাজে দূর্লভ। আমার দেখা আদর্শ মানুষের মধ্যে অন্যতম একজন হচ্ছেন নঈম চৌধুরী স্যার। মাঝে মাঝে ভেবে অবাক হই একজন মানুষ এতো পরিপূর্ণ হয় কি করে। তাঁকে কখনো অপ্রসন্ন দেখেছি বলে মনে পড়ে না। যখনি দেখা হয়েছে উপহার পেয়েছি একটি সি¥ত হাসিযেটা কখনও ভুলার নয়।

আমার সাথে নঈম চৌধুরী স্যারের ব্যক্তিগত পরিচয় দীর্ঘদিনের। আর দশজন মানুষের মতো হয়েও যে অনন্যঅসাধারণ হয়ে ওঠা যায়প্রয়াত নঈম চৌধুরী স্যার ছিলেন তাঁর সার্থক উদাহরণ। তাঁর বড় পরিচয়তিনি একজন উজ্জল মানবিক গুণাবলী সম্বলিত ভাল মানুষ  অতি ভালো মানুষ ছিলেন। মেধা থাকলে বিদ্যা অর্জন করা যায় কিন্ত ভালো মানুষ হওয়া যাবে এমনটি নিশ্চিত নয়। এর জন্য থাকা চাই বিশেষ গুণ আর নঈম চৌধুরী স্যার ছিলেন সেই গুণের অধিকারী। অত্যন্ত ভদ্রসদালাপীবিনয়ীউদার স্বভাবেরস্যার ছিলেন সকলের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। যারাই একবার তাঁর সান্নিধ্যে এসেছেনচমৎকৃত হয়েছেনদূরে ছুটে আর যেতে পারেননি কখনওযেমন পারিনি আমিও।

সততাদক্ষতানিষ্ঠা ও নিরপেক্ষতার এক উজ্জল দৃষ্টান্ত অধ্যাপক নঈম চৌধুরী স্যার। তাঁর চিন্তা ও  চেতনা ছিল অত্যন্ত উঁচু স্তরের। তিনি ছিলেন উদারমহৎ ও পরিচ্ছন্ন মনের মানুষ। এসব গুণ কোন কালেই সহজলভ্য ছিল নাএকালে তো রীতিমত দূর্লভ। সর্বক্ষেত্রে সফল মানুষটি ছিলেন খুবই ধীর ও স্থির ও নিষ্ঠাবান। স্যারের এ সফলতার পেছনে রয়েছে তাঁর সততা, দক্ষতাএকনিষ্ঠতাএকাগ্রতা ও মহানুভবতা। আর সে কারণে ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে তাঁর গোটা জীবনে তিনি যেখানে যে অবস্থায় থেকেছেন সে অবস্থাতেই আলোর স্ফুরণ ঘটিয়েছেন। শ্রদ্ধা করা যায়সম্মান করা যায়আস্থা রাখা যায় এ ধরনের মানুষের আজ বড় বেশী অভাব। মহৎ দৃষ্টান্ত হিসাবে তিনি উজ্জল হয়ে থাকবেনআমাদের সকলের জন্য। 

পৃথিবীতে কিছু মানুষ প্রকৃতি প্রদত্ত সৃজনশীল সাংগঠনিক প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন। নঈম চৌধুরী স্যার তেমনি একজন বিরল ব্যক্তিত্ব। বিভিন্ন কমিটির মিটিং এআলোচনা সভায় তাঁকে কখনই উত্তেজিত বা অস্থির হতে দেখিনি। সকলের মত শুনেছেনগ্রহণযোগ্য হলে মেনে নিয়েছেননিজের মতামত উপস্থাপন করেছেন অত্যন্ত শান্তভাবে যুক্তির সঙ্গে।  নিজের মতামত প্রকাশ করেছেন পরিস্কার ও স্বচ্ছ ভাবে কিন্তু কখনও অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে দেখিনি।  তাঁর একটি সম্মোহনী নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা আমি কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছি। তিনি সর্বদা কম কথা বলতেনশুনতেন বেশী। সবার মতামত  গ্রহণ করতেন এবং একটি বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত দিতেন। বিভিন্ন সেমিনারে তাঁর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা অন্য সবার মত আমাকেও বিমোহিত করতো।

তিনি আপন গুণে ছিলেন সমৃদ্ধ এবং প্রতিষ্ঠিত। তাঁর চারিত্রিক গুণের বৈশিষ্টে আমি ছিলাম অভিভুত। অনেক কঠিন কাজ স্যার অতি সহজেই সম্পন্ন করতে পারতেন তাঁর ব্যক্তিগত মোহনীয় আচরনের কারণে। নীতি ও সিদ্ধান্তের প্রতি তাঁর দৃঢ়তা লক্ষণীয়যদিও প্রকাশভঙ্গী থাকতো অনেক কোমল। সবাইকে সাহায্য করার মনোবৃত্তি ছিল তাঁর সহজাত। এক্ষেত্রে স্যারকে দেখেছি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ও উদার মানুষ হিসেবে। একজন পরোপকারীসহৃদয় ও প্রাণবন্ত মানুষ হিসেবে স্যার অনুস¥রণীয়। যেভাবে তিনি সকলের উপকার করতেনসাহায্য করতেন উষ্ণ হৃদয়েতাতে বোঝা যায় যে কেবল ভালোত্ব দিয়ে তাঁর পরিমাপ হবে নাবলতে হবে যে তিনি একজন মহৎ মানুষ ছিলেন। নঈম চৌধুরী স্যার কর্মজীবনে জয় করেছেন বহু মানুষের হৃদয়। তিনি ছিলেন একজন আত্মপ্রচারহীন ব্যক্তি। অন্যের দোষত্রূটি দেখে সমালোচনার মানসিকতা তার চরিত্রে ছিলনা। অন্যকে সম্মান করা তার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট। 

আমি নঈম চৌধুরী স্যারের সরাসরি ছাত্র ছিলাম না কিন্তু সবসময় নিজ শিক্ষকের মতো শ্রদ্ধা করেছি। স্যার কিছু সময়ের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। নঈম চৌধুরী স্যারের সহধমির্ণী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শামীমা চৌধুরী ম্যাডাম ছিলেন আমার সরাসরি শিক্ষক এবং আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন বিধায় বিভিন্ন প্রয়োজনে প্রায়ই স্যারের বাসায় যাওয়া হতো। স্যারের চরিত্রের যে দিকটি আমাকে সবচেয়ে বেশী আকৃষ্ট করেছে তা হচ্ছে তাঁর সহজেই আপন করে নেবার ক্ষমতাআময়িক ব্যবহার ও মার্জিত রুচি। তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় এক অনন্য মানুষ। খুব বিচক্ষনতার সাথে ঠান্ডা মাথায় ধৈয্যের সাথে তিনি কাজ করতে পারতেন। একজন আদর্শবান মানুষ অধ্যাপক ড. নঈম চৌধুরী স্যার নতুন প্রজন্মের জন্য একজন অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর কর্মেতাঁর আদর্শে।

এখনও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যেনঈম চৌধুরী স্যার আর নেই। বহু বছরের পরিচয়কালীন সময়ে তাঁকে চির তরুণই ভেবেছি। চেহারায় অবয়বে খুব বেশী পরিবর্তন দেখিনি। একদিনের জন্যও বার্ধক্য ছুঁতে পারেনি স্যারকে। তাই স্যারের আকসি¥ক বিদায় সত্যিই শোকবিহ¦ল করেছে আমাকে।

নঈম চৌধুরী স্যারের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।

ড. ইয়ারুল কবীর
অধ্যাপক
প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


Pages