অধ্যাপক ড. নঈম চৌধুরী স্যার - স্যারেকে নিয়ে স্মৃতিচারণ! এতো একটা বই হয়ে যাবে। স্যার ছিলেন প্রখর রোদ্দুরে একটুকরো মেঘ, সেই মেঘের ছায়াতলে আমরা নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াতাম। হঠাৎ এক বজ্রপাতে মেঘটা সরে গেল প্রবল বর্ষনে সবকিছু এলোমেলো করে দিল। যেদিন স্যার চলে গেলেন স্যারের জন্য সকালের আকাশটাও কেঁদেছিলো। আমি এসব কি লিখছি স্মৃতিচারণ অর্থ তো স্যারের চলে যাওয়ার বর্ণনা নয়! আমাকে ২৫/২৬ বছর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে।
আমরা তখন মাইক্রোবায়লজি বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছি। ক্লাস করছি একদিন শুনলাম বিভাগের শিক্ষক ছাড়াও এটমিক এনার্জি কমিশনের একজন স্বনামধন্য বিজ্ঞানী ড. নঈম চৌধুরী স্যার আমাদের Industrial Microbiology and Biotechnology কোর্সটি পড়াবেন । আমরা একটু ভয়ে ছিলাম, স্যার এলেন এসেই স্যারের সেই বিখ্যাত মিস্টি সপ্রভিত হাসি দিয়ে আমাদের সবার সাথে পরিচিত হলেন তারপর পড়ানো শুরু করলেন। প্রথম দিন থেকেই আমরা স্যারের ভক্ত হয়ে গেলাম।
আমাদের ক্লাস চলছে এর মধ্যে থিসিস ডিস্ট্রিবিউশন শুরু হয়েছে। সবার সুপারভাইজার ঠিক হয়ে গেছে। আমার বন্ধু বান্ধবী একেকজন ICDDRB, BAEC, BCSIR, JUTE রিসার্চ বিভিন্ন স্থানে থিসিস এর কাজ শুরু করে দিয়েছে। আমি কার সাথে কোথায় কাজ করবো? কে হবেন আমার সুপারভাইজার বিভাগ থেকে কিছুই শুনিনা। আমি আশফাক স্যার ও মুজিব স্যারকে ক্ষণে ক্ষণে বিরক্ত করি আমি কার সাথে কাজ করবো। উনারা শুধু হাসে। একদিন নঈম চৌধুরী স্যার এলেন আমাকে বললেন "তুমি আমার সাথে গবেষণায় কাজ করবে।" আমি বললাম স্যার "আমি সাভারে যাবো কিভাবে?" স্যার বললেন তুমি বিভাগে কাজ করবে। আশফাক স্যার ও মুজিব স্যার তোমার বিভাগের সুপারভাইজার। আমি শনিবার এসে দেখবো তোমার এক সপ্তাহের কাজ।"এই বলে স্যারও হাসেন। আশফাক স্যার ও মুজিব স্যারও হাসেন। তারপর নঈম স্যার বলেন "এখন তুমি খুশিতো তোমার এখন তিনজন সুপারভাইজার।" সেদিন স্যারের "সেন্স অফ হিউমার" সম্পর্কে জানতে পারলাম।
কিছুদিন পর আশফাক স্যার আমেরিকা চলে গেলেন। নঈম স্যার ও মুজিব স্যার আলোচনা করে আমাকে "Yeast Protease" নিয়ে কাজ করতে বললেন। কাজ শেষ করলাম। ফাইনাল পরীক্ষা, থিসিস জমা, ভাইভা সব শেষ। ল্যাবে যেয়ে টুকটাক গবেষণার কাজ করি। পাবলিকেশনের জন্য। ল্যাবে চারজন জুনিয়রকে কাজ শেখাই। স্যার ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়লজি বিভাগে অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করেছেন। রেজাল্টের জন্য উৎকন্ঠায় দিন কাটে। কি হবে ভালো করবো তো! কার্জন হলে আসা যাওয়া আর টেনশন। একদিন শহিদের ক্যান্টিনের সামনে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছি স্যার হঠাৎ পাশ দিয়ে যেতে যেতে বললেন "তুমি এখানে চা খাচ্ছো! তোমাদের রেজাল্ট বোর্ডে টাঙ্গিয়ে দেয়া হয়েছে। আমি স্যারকে কিছু না বলে বিভাগের দিকে এক দৌড়। পরে মনে মনে কত ভেবেছি স্যার না জানি কি ভেবেছেন।
স্যারের মতো এতো বড় মাপের, বড় মনের মানুষ আমি আমার জীবনে খুব কম দেখেছি। স্যার আমাদের পড়ানোর মাঝে মাঝে উনার পরিবারের গল্প করতেন। এখানেও স্যারের কাছে শিখেছি তুমি যত বড়ই হও তোমার পরিবার ও তাদের ভালোবাসা ছাড়া এর কোন দাম নেই।
পরিবারের কথা যখন বলতেন একদিন ম্যাডামের প্রসঙ্গে বললেন "তোমাদের ম্যাডাম শামীমা চৌধুরী আমার চেয়ে অনেক বেশি ব্রিলিয়ান্ট ও ইন্টেলিজেন্ট। তিনি অস্ট্রেলিয়াতে গবেষণার যে কাজ করেছেন আর অল্প কিছুদিন থাকলে তাঁর পি. এইচ. ডি. ডিগ্রী হয়ে যেতো। কিন্ত আমার পিএইচডি শেষ তাই তিনি তাঁর গবেষণার কাজ এম এস থিসিস হিসেবে জমা দিয়ে আমার সাথে চলে এসেছেন।" সেদিন আমি অবাক হয়েছি আমাদের দেশে খুব কম স্বামী আছেন যারা তাঁদের স্ত্রী সম্পর্কে এমন কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারেন। পদার্থবিজ্ঞান এর স্বনামধন্য অধ্যাপক ড. শামীমা ম্যাডামের প্রতি স্যারের সম্মান ও ভালোবাসা এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
একদিন স্যার ক্লাসে UHT Milk নিয়ে পড়াচ্ছিলেন তখন বললেন "আমার ছেলে রবিন এই দুধটা দিলেই ফেলে দিত কারন এটাতে একটা brunt flavour ছিলো। এতটুকু ছেলে কি করে বুঝতো এটা অন্য দুধ" শত ব্যস্ততার মাঝেও বাবা হিসেবে উনি কতো কাছে থেকে সন্তানদের মানুষ করেছেন। এটাও একটা শিক্ষা। এর মধ্যে রেজাল্ট বের হলো তার কিছুদিন পর আমার বিয়ে, স্যার তখন বিভাগের চেয়ারম্যান, দাওয়াত দিতে গেলে স্যার কার্ড হাতে নিয়ে দেখে বললেন" শামীমা আমার বিয়েও মার্চের মাসে হয়েছে, ৭ই মার্চ।" আমি তখন অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমার বিয়ের দিন আমাকে দেখে স্যার বললেন "She looks elegant" স্যারের মতো এতো অকপটে smartly বলতে পারা,
সবাই পারে না। স্যারের এই কথাটি আমার জন্য দোয়া ও আশির্বাদ হয়ে আছে। আমার বিয়ের শ্রেষ্ঠ উপহার।
তারপর চাকরি জীবনে প্রবেশ করলাম, সংসার, বাচ্চা সামলানো, উচ্চশিক্ষা, বেশ কয়েক বছর বিদেশে অবস্থান সব কিছু মিলিয়ে স্যারের সাথে অনেকদিন যোগাযোগ ছিল না। হঠাৎ হঠাৎ কোন কনফারেন্সে দেখা হতো। আর একটা কথা প্রায়ই মনে পড়ে যখন পিএইচডি করার জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এ্যাপ্লাই করছি স্যারের recommendation letter প্রয়োজন হলো স্যার তখন এটমিক এনার্জি কমিশনের মেম্বার। আমি যেতেই স্যার নিজে টাইপ করে চার পাঁচ কপি করে সব কাটাতে সিগনেচার করে দিলেন। তারপর বললেন "পড়ে দ্যাখো তোমার সম্পর্কে সব ভালো ভালো কথা লিখে দিলাম।" একটা লাইন পড়ে আমি একটু ইতস্তত করছিলাম। স্যার লিখেছেন "She is very popular among her friends and colleagues because of her pleasing personality".
আমি বললাম স্যার এই লাইনটা? স্যার বললেন বিদেশে এটাও একটা ক্রাইটেরিয়া। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর গত দশ বছর স্যারকে অনেক কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। আগে স্যারকে খুব ভয় পেতাম কিন্তু গত দশ বছরে সেই ভয়টা আবদারে পরিনত হয়েছিল। একদিন স্যারকে বললাম স্যার আমার প্রথম ব্যাচের ভাইভা আপনি external member, আপনার আসতে হবে, আমি আমার ছাত্রদের আপনার কথা বলেছি, ওরা living legend Professor Dr. Naiyuum Choudhury কে দেখলে অনেক encouraged হবে। শুনে স্যার হেসে দিলেন বললেন "বাবু শনিবার করো আমি আসবো" এইযে স্যার কখনও বাবু কখনও মা ডাকতেন এখনও মাঝে মাঝে কানে বাজে। স্যার এলেন ভাইভা নিলেন। আমি তখন বিভাগের চেয়ারম্যান, আমার ছাত্রছাত্রীরা তো মহাখুশি। তারপর আবার আমার আবদার স্যার বিভাগের নবীন বরণ অনুষ্ঠানে আপনাকে বিশেষ অতিথি হিসেবে আসতে হবে। স্যার এলেন, স্যারের জ্ঞানগর্ভ বক্তব্যে আমাদের শিক্ষার্থীরা উল্লসিত হলো। বিভাগের বিভিন্ন কাজে স্যারের দিক নির্দেশনার জন্য আমি ও জাকারিয়া ভাই স্যারের বাসায় চলে যেতাম। স্যার কোনদিন বিরক্ততো হননি বরং সবচেয়ে যা ভালো লাগতো প্রচন্ড ক্লান্ত অবস্থায়ও স্যার ড্রইং রুমে এসে সেই চির পরিচিত মিস্টি হাসি দিয়ে বলতেন "ওহ্ তোমরা কখন এসেছো"। স্যারের বাসায় যে কত খেয়েছি এ প্রসঙ্গে ম্যাডাম এর কথা না বললেই নয়। ম্যাডামের বাসায় সবসময় বিভিন্ন ধরনের মজার মজার খাবার থাকতো। এজন্য রুশোও বলতো দেখেছো ম্যাডাম কত গুছানো যখনই আসি ম্যাডাম কত কিছু খাওয়ান। ভোজন রসিক রুশোকে ম্যাডাম সবসময় জোর করে খাওয়ান।
স্যার বাসায়ও সবসময় ফরমাল ড্রেসে ফিটফাট থাকতেন এটা আমার খুব ভালো লাগতো। সিলেবাস এর কাজ স্যার আমাকে একরকম নিজ হাতে শিখিয়েছেন।
স্যারের ব্যক্তিত্বপূর্ণ সদা হাস্যময় মুখটা আর কোনদিন দেখবো না ভাবতেই মনটা বিষন্ন হয়ে উঠে। স্যারের সাথে উনার সুস্থ থাকাকালীন সময়ে আমার শেষ দেখা হয় ২৩ মার্চ ২০১৯। বিভাগের ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামে জাকারিয়া ভাই স্যারকে বিশেষ অতিথি হিসেবে দাওয়াত দিয়েছেন। স্যার আসবেন জেনেও আমার মনটা ততটা উৎফুল্ল লাগছে না একটু রাগ ও অভিমান হচ্ছে কারন জাকারিয়া ভাই আমাকে না জানিয়ে তারিখটা ঠিক করেছেন। কাউকে বলতেও পারছি না এদিনটি আমাদের একটা বিশেষ দিন। দিনটি আমরা শুধুই পরিবারের সঙ্গে কাটাই। কিছুই বললাম না দায়িত্ব অবহেলা করতে শিখিনি তাই যথাসময়ে বিভাগে উপস্থিত হলাম। নঈম স্যার এলেন "বললেন শামীমা তুমি আমাকে ফোন করলেন কেন?" এতো লজ্জা পেলাম কোন উত্তর দিতে পারলাম না। স্যারের এই স্পষ্ট করে যার কথা তাকে সরাসরি বলা! এমন মানুষ কি আর পাওয়া যাবে?
স্যার এসে বললেন "তোমার রুমটা এতোদিনে চেয়ারম্যানের রুম মনে হচ্ছে। গাছ নাই কেন?" এই যে সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ aesthetic sence ও উৎসাহ দেয়া এটা কতজন পারে।
ওরিয়েন্টেশন শুরু হলো স্যার সবসময যা করতেন আমার কলিগ ও ছাত্রছাত্রীদের কাছে আমার প্রশংসা করা শুরু করতেন । আমার তখন খুব লজ্জা লাগতো আবার মনে মনে একটা আনন্দ অনুভব করতাম। অধ্যাপক ড. নঈম চৌধুরী স্যারের স্নেহ পেয়েছি কজনের ভাগ্যে হয়। স্যার কে আমি যে কি পরিমান শ্রদ্ধা করতাম যে স্যার ফোন করলে আমি দাঁড়িয়ে যেতাম। যতক্ষণ কথা বলতাম দাঁড়িয়েই থাকতাম। মনে হতো স্যার সামনে আছেন। এখনও যখন স্যারের কথা মনে পড়ে স্যারের হাসিমাখা মুখটা ভেসে ওঠে। স্যারের অসুস্থতার সময় প্রায় হাসপাতালে চলে যেতাম। হাসপাতালে অনেক রেসট্রিকশন ছিলো স্যার কে মাঝে মাঝে দেখতে পেতাম দরজার কাছে দাড়িয়ে। কাছে যাওয়া নিষেধ ছিল যদি কোন ইনফেকশন হয়। তবুও যেতাম মন মানতো না। ম্যাডাম ও সারাহ রবিনের সাথে কথা হতো উনাদের কস্ট কাছে থেকে দেখেছি। স্যারের মেয়ে সারাহ ও ছেলে রবিনকে যত দেখছি ততই অবাক হই। ওরা অত্যন্ত বিনয়ী, ভদ্র, মার্জিত। আল্লাহ স্যারের পরিবারের সবাই কে ভালো রাখেন দোয়া করি । আমদের কাছে অধ্যাপক ড. নঈম চৌধুরী স্যার ছিলেন শিক্ষক ও গবেষক। স্যারের চলে যাবার পর স্যারের জন্মদিনের দিন স্যারের স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে স্যারের বন্ধু ড. সরোয়ার স্যারের কাছে শুনলাম স্যার বিদেশে থেকেও মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন। এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় জার্মানি থেকে পিএইচডির পড়াকালীন সময়ে মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে দেশে চলে এসেছিলেন। স্যার নিজে কোনদিন একথা কাউকে জানতেও দেন নি। স্যারের মতো নিভৃতচারী, প্রকৃত দেশপ্রেমিক, অকুতোভয় মানুষ খুব কম জন্মায়। এই ক্ষণজন্মা মানুষ টি অমর হয়ে থাকবেন তাঁর অগনিত প্রিয় ছাত্র ছাত্রীদের মাঝে। স্যারের জন্য অনেক অনেক দোয়া করি আল্লাহ তায়ালা যেন স্যার কে জান্নাতুল ফেরদৌসে স্থান দেন । আমিন। স্যারের ছাত্রী শামীমা ।
অধ্যাপক ড. শামীমা বেগম।
মাইক্রোবায়লজি বিভাগ।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
আমরা তখন মাইক্রোবায়লজি বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছি। ক্লাস করছি একদিন শুনলাম বিভাগের শিক্ষক ছাড়াও এটমিক এনার্জি কমিশনের একজন স্বনামধন্য বিজ্ঞানী ড. নঈম চৌধুরী স্যার আমাদের Industrial Microbiology and Biotechnology কোর্সটি পড়াবেন । আমরা একটু ভয়ে ছিলাম, স্যার এলেন এসেই স্যারের সেই বিখ্যাত মিস্টি সপ্রভিত হাসি দিয়ে আমাদের সবার সাথে পরিচিত হলেন তারপর পড়ানো শুরু করলেন। প্রথম দিন থেকেই আমরা স্যারের ভক্ত হয়ে গেলাম।
আমাদের ক্লাস চলছে এর মধ্যে থিসিস ডিস্ট্রিবিউশন শুরু হয়েছে। সবার সুপারভাইজার ঠিক হয়ে গেছে। আমার বন্ধু বান্ধবী একেকজন ICDDRB, BAEC, BCSIR, JUTE রিসার্চ বিভিন্ন স্থানে থিসিস এর কাজ শুরু করে দিয়েছে। আমি কার সাথে কোথায় কাজ করবো? কে হবেন আমার সুপারভাইজার বিভাগ থেকে কিছুই শুনিনা। আমি আশফাক স্যার ও মুজিব স্যারকে ক্ষণে ক্ষণে বিরক্ত করি আমি কার সাথে কাজ করবো। উনারা শুধু হাসে। একদিন নঈম চৌধুরী স্যার এলেন আমাকে বললেন "তুমি আমার সাথে গবেষণায় কাজ করবে।" আমি বললাম স্যার "আমি সাভারে যাবো কিভাবে?" স্যার বললেন তুমি বিভাগে কাজ করবে। আশফাক স্যার ও মুজিব স্যার তোমার বিভাগের সুপারভাইজার। আমি শনিবার এসে দেখবো তোমার এক সপ্তাহের কাজ।"এই বলে স্যারও হাসেন। আশফাক স্যার ও মুজিব স্যারও হাসেন। তারপর নঈম স্যার বলেন "এখন তুমি খুশিতো তোমার এখন তিনজন সুপারভাইজার।" সেদিন স্যারের "সেন্স অফ হিউমার" সম্পর্কে জানতে পারলাম।
কিছুদিন পর আশফাক স্যার আমেরিকা চলে গেলেন। নঈম স্যার ও মুজিব স্যার আলোচনা করে আমাকে "Yeast Protease" নিয়ে কাজ করতে বললেন। কাজ শেষ করলাম। ফাইনাল পরীক্ষা, থিসিস জমা, ভাইভা সব শেষ। ল্যাবে যেয়ে টুকটাক গবেষণার কাজ করি। পাবলিকেশনের জন্য। ল্যাবে চারজন জুনিয়রকে কাজ শেখাই। স্যার ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়লজি বিভাগে অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করেছেন। রেজাল্টের জন্য উৎকন্ঠায় দিন কাটে। কি হবে ভালো করবো তো! কার্জন হলে আসা যাওয়া আর টেনশন। একদিন শহিদের ক্যান্টিনের সামনে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছি স্যার হঠাৎ পাশ দিয়ে যেতে যেতে বললেন "তুমি এখানে চা খাচ্ছো! তোমাদের রেজাল্ট বোর্ডে টাঙ্গিয়ে দেয়া হয়েছে। আমি স্যারকে কিছু না বলে বিভাগের দিকে এক দৌড়। পরে মনে মনে কত ভেবেছি স্যার না জানি কি ভেবেছেন।
স্যারের মতো এতো বড় মাপের, বড় মনের মানুষ আমি আমার জীবনে খুব কম দেখেছি। স্যার আমাদের পড়ানোর মাঝে মাঝে উনার পরিবারের গল্প করতেন। এখানেও স্যারের কাছে শিখেছি তুমি যত বড়ই হও তোমার পরিবার ও তাদের ভালোবাসা ছাড়া এর কোন দাম নেই।
পরিবারের কথা যখন বলতেন একদিন ম্যাডামের প্রসঙ্গে বললেন "তোমাদের ম্যাডাম শামীমা চৌধুরী আমার চেয়ে অনেক বেশি ব্রিলিয়ান্ট ও ইন্টেলিজেন্ট। তিনি অস্ট্রেলিয়াতে গবেষণার যে কাজ করেছেন আর অল্প কিছুদিন থাকলে তাঁর পি. এইচ. ডি. ডিগ্রী হয়ে যেতো। কিন্ত আমার পিএইচডি শেষ তাই তিনি তাঁর গবেষণার কাজ এম এস থিসিস হিসেবে জমা দিয়ে আমার সাথে চলে এসেছেন।" সেদিন আমি অবাক হয়েছি আমাদের দেশে খুব কম স্বামী আছেন যারা তাঁদের স্ত্রী সম্পর্কে এমন কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারেন। পদার্থবিজ্ঞান এর স্বনামধন্য অধ্যাপক ড. শামীমা ম্যাডামের প্রতি স্যারের সম্মান ও ভালোবাসা এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
একদিন স্যার ক্লাসে UHT Milk নিয়ে পড়াচ্ছিলেন তখন বললেন "আমার ছেলে রবিন এই দুধটা দিলেই ফেলে দিত কারন এটাতে একটা brunt flavour ছিলো। এতটুকু ছেলে কি করে বুঝতো এটা অন্য দুধ" শত ব্যস্ততার মাঝেও বাবা হিসেবে উনি কতো কাছে থেকে সন্তানদের মানুষ করেছেন। এটাও একটা শিক্ষা। এর মধ্যে রেজাল্ট বের হলো তার কিছুদিন পর আমার বিয়ে, স্যার তখন বিভাগের চেয়ারম্যান, দাওয়াত দিতে গেলে স্যার কার্ড হাতে নিয়ে দেখে বললেন" শামীমা আমার বিয়েও মার্চের মাসে হয়েছে, ৭ই মার্চ।" আমি তখন অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমার বিয়ের দিন আমাকে দেখে স্যার বললেন "She looks elegant" স্যারের মতো এতো অকপটে smartly বলতে পারা,
সবাই পারে না। স্যারের এই কথাটি আমার জন্য দোয়া ও আশির্বাদ হয়ে আছে। আমার বিয়ের শ্রেষ্ঠ উপহার।
তারপর চাকরি জীবনে প্রবেশ করলাম, সংসার, বাচ্চা সামলানো, উচ্চশিক্ষা, বেশ কয়েক বছর বিদেশে অবস্থান সব কিছু মিলিয়ে স্যারের সাথে অনেকদিন যোগাযোগ ছিল না। হঠাৎ হঠাৎ কোন কনফারেন্সে দেখা হতো। আর একটা কথা প্রায়ই মনে পড়ে যখন পিএইচডি করার জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এ্যাপ্লাই করছি স্যারের recommendation letter প্রয়োজন হলো স্যার তখন এটমিক এনার্জি কমিশনের মেম্বার। আমি যেতেই স্যার নিজে টাইপ করে চার পাঁচ কপি করে সব কাটাতে সিগনেচার করে দিলেন। তারপর বললেন "পড়ে দ্যাখো তোমার সম্পর্কে সব ভালো ভালো কথা লিখে দিলাম।" একটা লাইন পড়ে আমি একটু ইতস্তত করছিলাম। স্যার লিখেছেন "She is very popular among her friends and colleagues because of her pleasing personality".
আমি বললাম স্যার এই লাইনটা? স্যার বললেন বিদেশে এটাও একটা ক্রাইটেরিয়া। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর গত দশ বছর স্যারকে অনেক কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। আগে স্যারকে খুব ভয় পেতাম কিন্তু গত দশ বছরে সেই ভয়টা আবদারে পরিনত হয়েছিল। একদিন স্যারকে বললাম স্যার আমার প্রথম ব্যাচের ভাইভা আপনি external member, আপনার আসতে হবে, আমি আমার ছাত্রদের আপনার কথা বলেছি, ওরা living legend Professor Dr. Naiyuum Choudhury কে দেখলে অনেক encouraged হবে। শুনে স্যার হেসে দিলেন বললেন "বাবু শনিবার করো আমি আসবো" এইযে স্যার কখনও বাবু কখনও মা ডাকতেন এখনও মাঝে মাঝে কানে বাজে। স্যার এলেন ভাইভা নিলেন। আমি তখন বিভাগের চেয়ারম্যান, আমার ছাত্রছাত্রীরা তো মহাখুশি। তারপর আবার আমার আবদার স্যার বিভাগের নবীন বরণ অনুষ্ঠানে আপনাকে বিশেষ অতিথি হিসেবে আসতে হবে। স্যার এলেন, স্যারের জ্ঞানগর্ভ বক্তব্যে আমাদের শিক্ষার্থীরা উল্লসিত হলো। বিভাগের বিভিন্ন কাজে স্যারের দিক নির্দেশনার জন্য আমি ও জাকারিয়া ভাই স্যারের বাসায় চলে যেতাম। স্যার কোনদিন বিরক্ততো হননি বরং সবচেয়ে যা ভালো লাগতো প্রচন্ড ক্লান্ত অবস্থায়ও স্যার ড্রইং রুমে এসে সেই চির পরিচিত মিস্টি হাসি দিয়ে বলতেন "ওহ্ তোমরা কখন এসেছো"। স্যারের বাসায় যে কত খেয়েছি এ প্রসঙ্গে ম্যাডাম এর কথা না বললেই নয়। ম্যাডামের বাসায় সবসময় বিভিন্ন ধরনের মজার মজার খাবার থাকতো। এজন্য রুশোও বলতো দেখেছো ম্যাডাম কত গুছানো যখনই আসি ম্যাডাম কত কিছু খাওয়ান। ভোজন রসিক রুশোকে ম্যাডাম সবসময় জোর করে খাওয়ান।
স্যার বাসায়ও সবসময় ফরমাল ড্রেসে ফিটফাট থাকতেন এটা আমার খুব ভালো লাগতো। সিলেবাস এর কাজ স্যার আমাকে একরকম নিজ হাতে শিখিয়েছেন।
স্যারের ব্যক্তিত্বপূর্ণ সদা হাস্যময় মুখটা আর কোনদিন দেখবো না ভাবতেই মনটা বিষন্ন হয়ে উঠে। স্যারের সাথে উনার সুস্থ থাকাকালীন সময়ে আমার শেষ দেখা হয় ২৩ মার্চ ২০১৯। বিভাগের ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামে জাকারিয়া ভাই স্যারকে বিশেষ অতিথি হিসেবে দাওয়াত দিয়েছেন। স্যার আসবেন জেনেও আমার মনটা ততটা উৎফুল্ল লাগছে না একটু রাগ ও অভিমান হচ্ছে কারন জাকারিয়া ভাই আমাকে না জানিয়ে তারিখটা ঠিক করেছেন। কাউকে বলতেও পারছি না এদিনটি আমাদের একটা বিশেষ দিন। দিনটি আমরা শুধুই পরিবারের সঙ্গে কাটাই। কিছুই বললাম না দায়িত্ব অবহেলা করতে শিখিনি তাই যথাসময়ে বিভাগে উপস্থিত হলাম। নঈম স্যার এলেন "বললেন শামীমা তুমি আমাকে ফোন করলেন কেন?" এতো লজ্জা পেলাম কোন উত্তর দিতে পারলাম না। স্যারের এই স্পষ্ট করে যার কথা তাকে সরাসরি বলা! এমন মানুষ কি আর পাওয়া যাবে?
স্যার এসে বললেন "তোমার রুমটা এতোদিনে চেয়ারম্যানের রুম মনে হচ্ছে। গাছ নাই কেন?" এই যে সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ aesthetic sence ও উৎসাহ দেয়া এটা কতজন পারে।
ওরিয়েন্টেশন শুরু হলো স্যার সবসময যা করতেন আমার কলিগ ও ছাত্রছাত্রীদের কাছে আমার প্রশংসা করা শুরু করতেন । আমার তখন খুব লজ্জা লাগতো আবার মনে মনে একটা আনন্দ অনুভব করতাম। অধ্যাপক ড. নঈম চৌধুরী স্যারের স্নেহ পেয়েছি কজনের ভাগ্যে হয়। স্যার কে আমি যে কি পরিমান শ্রদ্ধা করতাম যে স্যার ফোন করলে আমি দাঁড়িয়ে যেতাম। যতক্ষণ কথা বলতাম দাঁড়িয়েই থাকতাম। মনে হতো স্যার সামনে আছেন। এখনও যখন স্যারের কথা মনে পড়ে স্যারের হাসিমাখা মুখটা ভেসে ওঠে। স্যারের অসুস্থতার সময় প্রায় হাসপাতালে চলে যেতাম। হাসপাতালে অনেক রেসট্রিকশন ছিলো স্যার কে মাঝে মাঝে দেখতে পেতাম দরজার কাছে দাড়িয়ে। কাছে যাওয়া নিষেধ ছিল যদি কোন ইনফেকশন হয়। তবুও যেতাম মন মানতো না। ম্যাডাম ও সারাহ রবিনের সাথে কথা হতো উনাদের কস্ট কাছে থেকে দেখেছি। স্যারের মেয়ে সারাহ ও ছেলে রবিনকে যত দেখছি ততই অবাক হই। ওরা অত্যন্ত বিনয়ী, ভদ্র, মার্জিত। আল্লাহ স্যারের পরিবারের সবাই কে ভালো রাখেন দোয়া করি । আমদের কাছে অধ্যাপক ড. নঈম চৌধুরী স্যার ছিলেন শিক্ষক ও গবেষক। স্যারের চলে যাবার পর স্যারের জন্মদিনের দিন স্যারের স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে স্যারের বন্ধু ড. সরোয়ার স্যারের কাছে শুনলাম স্যার বিদেশে থেকেও মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন। এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় জার্মানি থেকে পিএইচডির পড়াকালীন সময়ে মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে দেশে চলে এসেছিলেন। স্যার নিজে কোনদিন একথা কাউকে জানতেও দেন নি। স্যারের মতো নিভৃতচারী, প্রকৃত দেশপ্রেমিক, অকুতোভয় মানুষ খুব কম জন্মায়। এই ক্ষণজন্মা মানুষ টি অমর হয়ে থাকবেন তাঁর অগনিত প্রিয় ছাত্র ছাত্রীদের মাঝে। স্যারের জন্য অনেক অনেক দোয়া করি আল্লাহ তায়ালা যেন স্যার কে জান্নাতুল ফেরদৌসে স্থান দেন । আমিন। স্যারের ছাত্রী শামীমা ।
অধ্যাপক ড. শামীমা বেগম।
মাইক্রোবায়লজি বিভাগ।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।